"মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।মুক্তিযোদ্ধা তথা জাতির বীর সন্তানেরা কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর নয় তারা পুরো বাঙ্গালী জাতির অহংকার । "

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম[১], বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ অগ্রদূত, পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের কেন্দ্রিয় কর্মী। আজীবন বঞ্চিত নিপীড়িত নারীর পাশে থাকা আয়েশা খানম, খুব সাধারণ জীবন ছিল তার কিন্তু স্মার্ট ও পরিপাটি।
জন্ম
১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলাধীন গাবরাগাতী গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা প্রয়াত গোলাম আলী খান পাঠান, মাতা- আয়েশা আমাতুন নেছা খানম, স্বামী- প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মুর্তুজা খান, কাটলি নেত্রকোণা; যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট এবং বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। একমাত্র মেয়ে ঊর্মি খানম আমেরিকাতে অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত।
শিক্ষাজীবন
বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম নেত্রকোণা সরকারী বালিকা বিদ্যালয় হতে ম্যাটিক পাশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন ৷
রাজনৈতিক জীবন
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবীতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হন। তার আন্দোলন সংগ্রাম প্রসঙ্গে ষাটের দশকের নেত্রকোণায় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ,ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রনেতা, নেত্রকোণার মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নেত্রকোণার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে একমাত্র শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অন্যতম (সরকার নির্ধারিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা অনুযায়ী) জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মেহের আলী তার ডায়রেীতে লিখেছেন, “ In the month of September, 1962 Ms Aysha Khanum who was reading in class X was very known to me… It is a red letter day in the history of Netrakona subdivision that our sisters,the student of netrakona girl’s school, cooperate with us for the demand.The procession was led by Aysha Khanom. Founder President of Bangladesh Mohila Parishad. The then government bent down his head to the Mass of the people. 9th October, 1963, the student together with political leaders have arranged a large meeting. As they are informed, they came from various schools to attend the meeting on that day at 5pm…….”
আয়েশা খানম ১৯৬৩ সনের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার মাধ্যমে রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শুরু করেন । মেলার পরিচালক হিসেবে ছিলেন জনাব এডভোকেট একে ফজলুল কাদের, আর উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন- সর্বজনাব এন আই খান,জনাব আব্দুল খালেক, জনাব খালেকদাদ চৌধুরী, ডা. জগদীশ দত্ত, এডভোকেট ফজলুর রহমান খান,মাওলানা ফজলুর রহমান খান,হাবিবুর রহমান খান প্রমুখ। শহীদ মেহের আলী ছিলেন মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক । জনাব মেহের আলী শামসুজ্জোহাকে আহ্ববায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আয়েশা খানমকে আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেন।[২]
জাতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তিনি আন্দোলনের প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। ৬ দফা, ১১ দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংগ্রামী জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন। ৭০ এর নির্বাচন ও ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন সবগুলোতে তিনি সামনের সারিতে ছিলেন। ভয় শব্দটার সাথে তার পরিচয় ছিলোনা কখনো। ২৫শে মার্চ রাতে আয়েশা খানম মৃত বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে চার পাশে, তার পিতা ও স্বজনেরা জানতে পারেন যে, সে মৃত। অথচ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে রোকেয়া হলে ছাত্রী সংসদে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহন করে ঢাকায় ছাত্র/ছাত্রীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল মূলত আয়েশা এবং তার সহকর্মী ছাত্র নেতাদের উপর। তিনি ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করে মহিলা ব্রিগেড গঠন করেন। তাঁর সাথে সহযোদ্ধা হিসাবে ছিলেন মালেকা বেগম, মনিরা আক্তার, কাজী রোকেয়া সুলতানা, রিনা খানম প্রমুখ নারীনেত্রী। তাছাড়া ছাত্র নেতা হিসাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও সচেতনতার কাজেও সক্রিয় অংশগ্রহন করেছেন। তিনি সাজেদা চৌধুরীর সাথেও কাজ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
ডয়েসে ভেলের সাথে একান্ত স্বাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ”ছাত্র সংগ্রাম কমিটি যেটা গঠিত হয়েছিল সেটার উপর দায়িত্ব ছিল সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা। এছাড়া বিশেষ করে ৭ মার্চের পর থেকে ঢাকা শহর সংগঠিত করা এবং যোগাযোগ রক্ষা করা ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছিলাম। সেই সময়ের বন্দুক কাঁধে করা একটি ছবি, এখন সবাই দেখতে পান সেখানে আমিও রয়েছি।” এপ্রিল মাসের শেষ দিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যান আয়েশা খানম। সেখানে কমিউনিষ্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ক্রাফটস হোস্টেলে উঠেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যারা ভারতে আসতেন তাদের এক অংশের সাময়িক আবাসস্থল ছিল ক্রাফটস হোস্টেল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা, প্রণোদনা দান এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে কাজ করেন আয়েশা খানম এবং তার সহকর্মীরা। আগরতলায় তার কাজের কথা বলতে গিয়ে আয়েশা খানম জানান, ”আগরতলায় আমি প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ নেই। চিকিৎসা সেবার উপর। এর পর আগরতলার প্রতিটি ক্যাম্পে গিয়ে যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে আত্মনিয়োগ করি। এছাড়া বিভিন্ন অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানোর আগে তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা হতো। সেখানে তাদেরও ওরিয়েন্টেশন দেওয়ার কাজ করতাম। আমি যেহেতু আগে থেকেই সচেতনতা সৃষ্টির কাজে এবং বক্তৃতা ও কথা বলার ক্ষেত্রে জড়িত ছিলাম, সেজন্য বোধ হয় সেখানেও আমাকে এধরনের কাজেই বেশী করে জড়িত রাখা হয়েছিল।”এছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐতিহাসিক বক্তৃতা নিয়েছিলেন আয়েশা খানম মুক্তিযুদ্ধ কালীন দীর্ঘ ৯ মাসের নানা স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে একটি তুলে ধরে আয়েশা খানম বলেছিলেন- “আমি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে যে দিন প্রথম আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় যোগ দিলাম সেটা ছিল আমার কাছে খুবই স্মরণীয়। কারন আমি সেই দিন খুব আনাড়ি হাতে হলেও আহত কিশোর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতস্থানগুলো পরিস্কার করে যখন ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছিলাম, তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল- আমি সত্যি দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য সরাসরি কোন কাজ করছি”।স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন তিনি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং আয়েশাখানম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ২ নং সেক্টরে একসাথে কাজ করেছেন।
সমাজসেবা
জেন্ডার বিষয়ে কাজ করার সুবাদে আয়েশা খানমের সাথে ছিলেন হেনা দাস, বেলা নবী, মালেকা বানু, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, রোকেয়া কবির, আরমা দত্ত, হামিদা হোসেন, শামীম আক্তার সহ আরো অনেকেই। প্রায় ৬০ এর বেশী সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছে আয়েশা খানমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৯৫ সালে বেইজিং এ ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহন করেন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনাবসানের পূর্ব মুহুত পর্যন্ত তিনি নারীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ও মুক্তি এবং সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গেছেন।
পুরষ্কার ও সম্মানণা
ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য “Bangladesh Muktijudho Research Institute Silver Award-2023” সম্মাননা প্রদানের জন্যে মনোনীত করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ[]
- ↑ সামির, আহমেদ(প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক),“ বাংলাদেশে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতীক : বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম”, নেত্রকোণা জার্নাল,৩১/০৭/২০২৩
- ↑ https://netrokonajournal.com/2023/07/30/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%95-%e0%a6%ac%e0%a7%80/